পাখির কাছে স্বীকারোক্তি

পাখি বিষয়ক কবিতা


পাখি বিষয়ক কবিতা


১.

জোড়া শালিক

____________


বড় বাড়ির খোলা উঠোন
    ধানে গমে ছড়াছড়ি
    শালিকের ভাতঘর
     সারাদিন ওড়াউড়ি

ওরা আসে দলে দলে খুঁটে খায় বৈভব
কারো গরজ নেই ওদের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার
শুধু শালিক একলা এলেই বাড়ির
বৌ-ঝি এমন কি পুরুষরাও দূর দূর করে
গাল দেয় 'অ' এর উপসর্গ যোগে
একলা শালিক আর 'সিঙ্গল মাদার'
সমাজের বুকে নাকি ভয়ানক কুলটা
জনসমক্ষে মুখ দেখিও যদি পাও জোড়াটা
কেন শমনে কি সাথী লাগে?
নাকি পটি করতে পতি লাগে ?
একলা প্রাণ, আত্ম সম্মান, বাঁচার গান
ভীষণ বুঝি সস্তা?
গাধা আর কত দিনই বা বইবে
পোড়া নুনের বস্তা?


২.

কাক-কোকিল সম্পর্ক

__________________

কোকিলের বাসায় ক্যালেন্ডার নেই তাই কাকের বাসায় ডিম পাড়ে
সবাই বলে কোকিল চতুর কিন্তু কেউ বলে না
কাক বোকা কারণ সে আশ্রয়দাতা

কোকিল সঙ্গীত শিল্পী
অন্যদের মতো শুধু সংসার করলে তার চলবে কেন? তাই সারা বছর বসন্তের জন্য রেওয়াজ করে গলা সাধে, গোপনে রেখে যায় 'কুহু' ডাকের উত্তরসূরী।

কাক কোকিলের ডিমে তা দেয়
যত্নে বাচ্চা লালন করে
ডানা বড় হওয়ার অনেক আগেই উড়ে যায় কোকিল ছানা, খুঁজে নেয় পছন্দ মতো গানের স্কুল।

কাকের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, চশমা দরকার
পাখিদের হাসপাতালে শকুনকে রাখতে হবে চোখের ডাক্তার, কাঠ ঠোকরা পাখি সহজেই হতে পারবে চশমা তৈরীর কারিগর।


৩.

গৃহপালিত পাখিরা আসলে মুরগি

___________________________

তখন স্কুলে পড়ি, আমার একটা ছোট্ট টিয়া ছিল
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে ছিলাম নিরঞ্জনদের বাড়ি থেকে। আমার ভাঁড় ভাঙা সাড়ে ছেচল্লিশ টাকা, সাড়ে তিন টাকা কম পড়েছিল কিন্তু এক পয়সাও কম নেয়নি নিরঞ্জনের বাবা অথচ নিরঞ্জন লুকিয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছিল তাতে রক্ত দিয়ে লেখা ছিল আমার নাম। বাবার সামনে ওকে ধবধবে সাদা দেখাতো ঠিক খরগোসের মতো তাই ওর বাবাকে আমি অমরেশ পুরি বলে ডাকতাম।

ভগ্নাংশ পূরণের জন্য অগত্যা হাজির হয়েছিলাম সেই মানুষটির কাছে যার অভিধানে একটিও নেতিবাচক শব্দ জোগায়নি বাংলা বর্ণমালা। ওই আঁচলের খুঁটেই বাঁধা থাকতো আমার শৈশবের হাজার রকম বিলাসিতা। পাখিটি যখন প্রথম  বাড়িতে নিয়ে এলাম মা বলেছিল, এমা একটাও পালক নেই, এটা কী পাখি !
ঠাম্মা বলেছিল, শকুন শকুন । আমি গর্জে উঠে
বলেছিলাম, বুড়ি ! এই যে লাল ঠোঁট, এটা শকুন? কানা কোথাকার। তারপর পড়াশোনা সিকেই তুলে
রোজ চলতে থাকলো পালক বোনার কর্মসূচি
অতি যত্নে প্রথম যেদিন সবুজ আস্তরণ পরলো পাখিটার গায়ে মনে হয়েছিল জৈষ্ঠ্য ফুরিয়ে বর্ষা এল।

এইভাবেই একদিন সবুজ পাতায় ভরে উঠল পাখির
শরীর। রোদ দেখলেই ও চেষ্ঠা করতো ওড়ার
বাবাকে ঠাম্মা বলেছিল, ডানা ছেটে দে নয়তো পঞ্চাশ টাকা জলে যাবে। আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি পাখিটা আর উড়তে পারছে না কেবল থপ থপ করে লাফাচ্ছে। আমার অসহ্য লাগলো, বললাম, পাখা না থাকলে তাকে পাখি বলা যায় না এটা একটা আস্ত মুরগি। ঠাম্মা ফোকলা দাঁতে বলেছিল মুরগি হলে তবুও তো ঝোল হতো। আমার কান্না পাচ্ছিল। পাখিটাকে কেমন নকল মনে হচ্ছিল। আমাদের পিয়ারা গাছে একটা সত্যিকারে টিয়া পাখি এসে বসতো, চেয়ে চেয়ে দেখতাম পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাতার মতো পাখিটাকে তারপর যম একদিন বেড়াল সেজে এল
নিয়ে গেল পাখিটার আত্মা‌, পড়ে রইলো পদার্থ।
বাড়ি সুদ্ধ সবাই আমার ভাঁড় ভাঙা পঞ্চাশ টাকার খুব জন্য আফসোস করলো। দাদা পাখিটাকে উঠোনে পুঁতে দিয়ে একটা বেলফুলের গাছ লাগিয়ে দিল। আমাকে বলল, দেখবি মাটি পেলে পাখিটা ফুল হয়ে যাবে।


৪.

নোটিশ

__________

যে পাখিটা উড়তে পারে দূরে মেঘের গোপন শহর দিয়ে, বুঝতে পারে কত মেঘে কত জল
সেই পাখিটা আমার পূর্ব পরিচিত

একদিন আমি কাঁদছিলাম
মানুষ মরলে যেমন কাঁদে সেই সুরে
পাখিটা ভরদুপুরে আমার জানলায় উড়ে এসেছিল ঠোঁটে রোদ নিয়ে
বলেছিল, অশ্রু সীতার মতো পবিত্র কিন্তু তরল নয়
তরল হলে সব রঙ মিশে যেত কান্না পেলে
যে দিনরাত কাঁদে সে শুধু পৃথিবীর রঙ নষ্ট করে

আমি আর নষ্ট করি না জলরঙ
পাখিটাকে কথা দিয়েছি আমার ইহকালের সমস্ত অশ্রু জমা রাখবো অক্ষরে অক্ষরে
জমা রাখবো সিঁদূর কৌটোয়
পাখিদের ঈশ্বর, মৃত্যুর আগে তুমি দেখে যেও
রকমারি ফুল ফুটবে আমার সিঁথির দুপাশে
ফল ধরবে পাখিদের নিজস্ব আবাসে
কেউ আঙুল তুলে আর কক্ষনো বলতে পারবে না
পাখিরা চোর, ওরা ফল চুরি করে।


৫.

প্রকৃতি

_______

পাখিটা, টিপেছে ট্রিগার, ছুঁড়েছে গুলি
জখমি বহেড়া
                                  নিহত ফুলগুলি

প্রজাপতি,
      বেচেছে খামার
                   ছেড়েছে বাড়ি
                            বাতাসে বারুদ ওড়ে
                                            বনে মহামারি                 
ওরা মুনাফালোভী,
চোরা পথে কাটছে গাছ
                                 ধরছে মাছ

প্রকৃতি এতোই বোকা        বোঝেনি তাই

জলে যুদ্ধ জাহাজ             স্থলে ধাপ্পাবাজ



  ৬.

বাদুড়ের বার্তা

____________

পাখি নই প্রাণী আমি, লোকে স্তন্যপায়ী বলে
চোখে দেখি কম, শুধু পথের শব্দ শুনি কানে
পাখিরা করেছে ত্যাগ প্রাণীরা করেনি গ্রহণ
তবুও আমি ঝুলে থাকি ডালে মোচার মতোন

সারাদিন ঘুম ঘুম ঝিমধরা ভাব, স্বপ্নের অভাব
রাতে বের হই ডাকাতি করতে এই তো স্বভাব
প্রতিকূলতা পারেনি হারাতে, বাঁচার তাগিদ বড়
যে সয় সর্বদা সেই রয়, অক্ষমতাকে অস্ত্র করো।



৭.


'বিশ্রাম চাই' বলেছিল, বক

______________________

'বিশ্রাম চাই' বলেছিল বক
সাত পুরুষ ধরে উড়ে পাখায় ব্যথা
আর ওড়ার দরকার নেই
এবার ঝঞ্বাহীন শান্ত হোক আকাশ

শুধু পাখনা মেলে ভেসে থাকুক উৎকন্ঠা
নিয়তি ঠিক করুক এয়ারপোর্ট কদ্দুর
ড্রাইভার ঘুমাক একটু, ওর বড্ড ঘুমের দরকার
সংসারের জোয়াল টানতে টানতে
চোখ লেগে যায় প্রায়ই
বৃষ্টি কোল পেতে দাও
ঘুম আসুক পা টিপে টিপে

'বিশ্রাম চাই' বলেছিল বক
ফুয়েল ছাড়া বিমান যদি না ওড়ে
বকেরা কেন নিজেদের দর কমাবে?



৮.

গাংচিলের গদ্য

______________

পরিযায়ী পাখিদের পথ ভুল হয় না
ওরা যানজট ত্যাগ করে গোলক ধাঁধাঁ এড়িয়ে চলে
সহজ মেঘেদের বন্ধু করে, সহজ মেঘ মানে সাদা মাটা একঘেয়ে নীল-সাদা ছাপা শাড়ি পরা
যে মেঘেগুলো রোজ আকাশ ঝাঁট দেয়
পরিষ্কার রাখে পথঘাট, আবহাওয়া
গাংচিল উড়ে যায় সেই পথ দিয়ে
ওই পথে হেব্বি স্বস্তি, মজার সরাইখানা
খিল খিল হাসি খল্ বল্ করতে করতে
ঝর্ ঝর্ বৃষ্টি  হঠাৎ হঠাৎ
ওই পথে মেঘেরা মঙ্গলঘট পাতে
সারাদিন নার্সের মতো সেবা করে আর্তের
ও পথে হারিয়ে গেলেও আঁধার নামে না
ও পথের এপিঠ ওপিঠ দুপিঠ আলো



৯.

মুনিয়া মন্ত্রী

__________


পাখিটা মুনিয়া পাখিটা গরীব পাখিটা ছাত্রী
পাখিটা ভারতের ইতিহাস ভালোবেসে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিল।


সমসাময়িক রাজনীতি তখন উত্তাল
শ্রেষ্ঠত্বের একচেটিয়া দখল কেবল পুরুষদের হাতে

পাখিটার মাথায় বসলো লাঠি, পাখা দিল ছেঁটে তবুও পাখিটা টুঁ শব্দ করলো না
মাটি কামড়ে পড়ে থাকলো।

চিৎকার করে বললো, 'বিপ্লব দীর্ঘজিবী হোক'
পাখিটা বনে বনে ঘুরে বেড়ালো
বেনু বনে মুক্ত ছড়ালো।

পাখিটা গাছ গাছালিদের নিয়ে নতুন
ঘন সবুজ একটা দল গঠন করলো
দু হাজার সালের বন্যার মতো হড়হড়িয়ে
                                               ভোট এলো
উপছে পড়লো জল শহরের অলিতে গলিতে
গ্রামের খাল-খন্দে,
পাখিটা গাছ গাছালিদের প্রতীক করে
বিপুল ভোটে জয়ী হলো

ভোটে জিতেই পাখিটা হঠাৎ জাহাজ হয়ে গেল
                                       ভেসে চলল দূরে
সাগর জোড়া আকাশ, ঢেউগুলো সব মেঘ
মদের গ্লাসে ছলকে ওঠে হুইস্কি দু চার পেগ


১০.

চড়ুই পাখির দোলনা

_________________

বাড়ির পূব কোণ
সৈন্য সাজিয়ে শিমূল সেনাপতি
অতিথি হয়ে এসেছিল পরাশ্রয়ী স্বর্ণলতা
                                   আর ফিরে যায়নি
পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে
শিমূল তুলোর নরম বালিসে
মেঘ ডাকলে লতা নুয়ে পড়ে মাটিতে
যেভাবে লাজুক নারী প্রথমবার মুখ লুকায় প্রিয় পুরুষের বুকে। পশ্চিম পাড়া থেকে উড়ে আসে
এক ঝাঁক চড়ুই, গান গায়, নাচ করে
সোনার লতা ধরে দোল দোল খেলে

দোলনা ওদের খুব প্রিয়
দুলতে দুলতে ওরা মানুষকে বলে
তোমারা যে আর গম শুকোতে দাও না ছাদে?
প্যাকেটের আটা খাও বুঝি? মনে রেখো,

চাকি পেষা আটা খেতে ভারি মিষ্টি
রুটি খেও গোটা দশ যদি হয় বৃষ্টি ।


১১.

বাবুই-এর ঠোঁটে জ্যোৎস্নাজরি

_________________________
             
মানুষ ঘর ভাঙছে বাদামের মতো
                            সম্পর্ক ভাঙছে আরো দ্রুত
বাবুই পাখি তাঁত বুনছে। বুনছে বালুচরি
শাড়ির মেঝেতে ডুংরি নদীর তট
বালি চিক্ চিক্
               
সারাদিন আলোরা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে

এখানে সকাল সন্ধ্যা শুধু মানুষের কলহ
শোনা যায় না পাখিদের কালতান
মানুষ দিন দুপুরে ঘর ভাঙে
বাবুই ঠিক তার বিপরীতে যত্নে ঘর বাঁধে, প্রসব করে
ছানাদের জন্য বানায় বালুচরির বিছানা
চাঁদের বালিস।


১২.

পাখিদের পিঠে উৎসব

___________________

বনময় পৌষ সংক্রান্তির মেলা
গাছেরা পসার সাজিয়েছে
                       রকমারি ফল-ফুল সুগন্ধী
নদী সাজিয়েছে বুক
ঢেউ-এর নাগরদোলা
আকাশে মেঘের মান্দাস
মৃত স্বামীর প্রাণ ফেরাতে বালিহাঁস নিরুদ্দেশ

আজ পাখিদের পিঠে উৎসব
ঢেঁকি পেতে চাল কোটে চাঁদবৌ
কাঠঠোকরা পুরুষেরা পালা করে ঢেঁকিতে পাত দেয়। দোয়েল পাখির বাসায় দুধ পিঠের গন্ধ
ছোট্ট ছানাদের আনন্দ বেড়ে দেয় মা-দোয়েল
ওদের হাসি হাসি মুখ
ময়ূর-ময়ূরী পেখম মেলে
                             পায়ে তাদের বৈঁচি ফলের ঘুঙুর
ফিঙে পাখি যত্নে আঁশফলের পুর দেয় নরম পাটিসাপটার ভিতর

পরিযায়ী পাখিরা আজ অতিথি
সভা আলো করে গাছের ডালে ডালে বসে
গিন্নি পাখিরা ওদের তোয়াজ করে
                              খেতে দেয় পিঠেপুলি



১৩.


মাছরাঙা মাঝি

______________


বর্ষায় নদী উত্তাল হয়, মাছরাঙা মাঝি গলুই এ চুপটি বসে
দাঁড় ধরে থাকে, হাওয়ায় স্রোত ভাঙে, স্রোত গড়ে
নৌকো এগিয়ে চলে দুবলার চরের দিকে
মৌরালা সরপুঁটি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায় কেয়া বনে
গাছের পাতার ওপর শুয়ে ওরা আঁশ শুকোয় মৃদু রোদে
সূর্যের বেগুনি আলোয় ওদের আঁশ হীরের নাকছাবির  মতো জ্বল জ্বল করে, কেউ কেউ ফুলের মতো নিজেকে আহুতি দেয় মাছরাঙার ঠোঁটে, মাছরাঙা আর মাছ খায় না
বুঝে গেছে ওরা জলের ফল
                                  ওদের শরীরে ফুলের গন্ধ
মানুষ বোঝেনি, মানুষ মাছ খায়
ফুল-ফল-পাখি সব খায়
অসহায় মাছরাঙা গলুই-এ বসে অপলক চেয়ে থাকে।
কানের মধ্যে বাজতে থাকে ছলকে ওঠা জল
আর ঝাঁকি জালের ঝপ্ ঝপ্ শব্দ



সাঁঝ..



আর‌ও পড়ে দেখুন

Comments

  1. বাহ! প্রতিটা কবিতাই অসাধারন এবং একেক্টি একেক্রকম তাতপর্যপূর্ণ। কখনো 'Single Mother' এর গল্প এক শালিক দিয়ে, অসংখ্য উপমা সমেত, বা কাক কোকিলের সম্পর্ক দিয়ে মানুষ অ সন্তানের গল্প। টিয়ার গল্পটি সত্যিই মন ছুয়ে যায়। মুনিয়ার কবিতাটি ছাপা হলে নির্ঘাত বিজেপি থেকে টিকিট পাবেন। :-D

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিচ্ছেদের কবিতা

কবিতা

বিষণ্ণতার গল্প

জীবনের কবিতা

ভাঙন

আধুনিক কবিতাগুচ্ছ

প্রেমের কবিতা

বৃষ্টি কুঁড়িগুলো ফুটবে