যুদ্ধনদী এবং অনন্য








যুদ্ধনদী- ১

অস্থি মজ্জার সবটুকু রস নিংড়ে
তোর জন্য একটা নদী বানিয়েছি
ভালোবাসাগুলো গড়িয়ে দিয়েছি
            সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে

আমার বাড়ির সামনে
ধূ ধূ নকসী কাঁথার মাঠ
রক্ত পায়ে হেঁটে চলে
দলছুট গঙ্গা ফড়িংয়ের দল

অমাবস্যার অন্ধকারে
ডুব সাঁতার দিচ্ছে একজোড়া পানকৌড়ি
জামরুল বনে কাঁদে
নিঃসঙ্গ ঝিঁঝিঁ পোকা

তুইহীন আমার ড্রয়িং রুম
সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে
আমি তোকে খুঁজছি
শহরের আলো আঁধারে

আবার যুদ্ধ, আবার বিস্ফোরন
নির্বাক হিরোসীমা
লেকের ধারে দুটো ঠোঁট
জলে ছায়ার ছোঁয়াছুঁয়ি 



যুদ্ধনদী- ২

সকালের কুয়াশায় তোকে প্রথম দেখলাম
আগুন্তুকের মতো হাঁ করে তাকিয়ে ছিলিস
চোখে আগুন অথবা ফাগুন
                        কিছু একটা অন্যরকম ছিল
তাই চোখে মেলাতে পারিনি চোখ
তুই শূন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলিস,
কিচ্ছু চাই না শুধু আঙুলের ফাঁকগুলো
ভরাট করে দে
আমি হেসে তোকে এড়িয়ে গেছলাম
তবুও তুই হাতটা সরিয়ে নিসনি
স্টেশনের ভিখিরিগুলোর মতো একই ভাবে
পেতে রেখেছিলিস
আমি সলতের মতো পুড়ছিলাম,
লজ্জা নামের ক্ষীণ এক আগুন
প্রদীপের মতো আলোকিত করছিল আমাকে
মাথার ওপর এক ঝাঁক শালিক ঝগড়া করছিল
আমার ইচ্ছে করছিল,
এখুনি সীতার মতো পাতাল প্রবেশ করি
অথবা এক দৌড়ে চলে যায় নির্জন কোনো গাছতলায়
ব্যাণ্ডেল কাটোয়া লোকালটা আমাকে বাঁচিয়ে দিল
তুই ছোটো হতে হতে এক সময় মিলিয়ে গেলি



যুদ্ধনদী -৩

আমি ভালোবাসি রক্তকরবী
আমার মননে রঞ্জন, আমার যাপনে রঞ্জন
তুই তো রঞ্জন না, তুই রাজাও না!
তুই বিশুপাগল, তুই আমার প্রকার
তোর মধ্যে দিয়ে আমি বাহিরকে দেখি
তুই তো গান গাইতেও জানিস না
সুর-তাল-লয় এগুলোর মানে বুঝিস?
তুই যাচ্ছেতাই রকমের হ্যাংলা
তীর্থের কাকের মতো সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকিস
আমার যুদ্ধনদীর পাহারাদার হয়ে
কেউ তোকে আগে বলেছে?
তোর পাগলামি অসহ্য রকমের!
কেবল তোর অগোছালো শব্দমালা
অনাবিস্কৃত গালি আমাকে কবিতা লেখায়
তুই নন্দিনী বলে যখন বার বার ডাকিস
আমি তখন শ্রাবণমাসের অপ্রতিরোধ্য পদ্মা
ঝুপ ঝুপ করে ভাঙি, কেবল ভাঙি
                                        আবার ভাঙি



যুদ্ধনদী -৪

তোর প্রেমিকার পাতলা ঠোঁট
                     তোর ভরাট চুমু
কুলোয় না ওর ঠোঁটে
তোর বৌয়ের মোটা ঠোঁট
ওর চুমুর স্থানাভাব তোর ঠোঁটে
আমি প্রচণ্ড শীতেও শুষ্ক রাখি ঠোঁট
                                     ভেসলিন মাখি না
কারণ তোকে খেতে যাওয়া
অনভ্যাসের প্রথম চুমুটা
যেন ভেসলিনের প্রলেপে পিছলে না যায়



যুদ্ধনদী- ৫


তোর বোতামের নীচে একটা ঝর্ণা
           সারাদিন ঝির ঝির
    ঝাউবন পেরিয়ে বয়ে চলেছে
        ব্লাউজ উপত্যকার দিকে

তোর নাভিমূলে সৃষ্টির বীজ
                   আরো নীচে মৌনালোয়া
আমার গর্ভ ধানের গোলা
 আরো নীচে পোষা নদী

চল্ প্রতিদ্বন্দ্বী হই
তলোয়ারের আঘাতে আঘাতে
বুকে আঁকি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত



যুদ্ধনদী -৬


শীতের দুপুর খোলা ছাদ
সাপ লুডোতে কিস্তিমাৎ
আমার জন্য স্বর্গের সিঁড়ি
তোর জন্য সাপের ছোবল
আমার জন্য পুট ছক্কা
তোর জন্য মনসামঙ্গল

আমার নদীতে জোয়ার এখন
তোর বুকেতেই আঁছড়ে পড়ি
বাঁচার মতো বাঁচার হলে
চল্ যুদ্ধের পাঠটাই মুখস্থ করি।




যুদ্ধনদী -৭


বড়দিনের ছুটিতে একটা ছোট্ট ট্যুর হওয়া চাই
                                        পাহাড় কিংবা সমুদ্র

হোটেল নামি কমদামি যেমনই হোক
একটা স্লিভলেস রাতপোষাক চাই
চাকুরিজীবি বিবাহিত দম্পত্তিদের
একটি বিশেষত্ব হলো,
এরা শুধু নিজের বিছানায় মরে না
প্রথম সহবাসের মোহে এরা
                     দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ট্যুর করে
পাশের বাড়ি আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে
এদের শুধু একটা বিছানা চায়
তাহলেই হাসিমুখে আত্মহত্যা

আমি তোকে এই জীবগুলোর থেকে আলাদা ভাবি
জানি শরীর তোর কাছে চৌকাঠ
                              আত্মায় প্রবেশের দ্বারমাত্র

আমার স্তনবৃন্তে বন্দি যে চড়ুই
তোর আঙুলে ওর মুক্তি লেখা হোক
নীল আকাশে উড়িয়ে দে ওর পালক
আমার স্নানের ঘরে আজন্ম বাঁধা আছে
                                                     এক নদী
সে নদীপথে এখন কুরুক্ষেত্র
গভীরে প্রবেশ করে দ্যাখ,
অসহায় কর্ণ আজো প্রাণপণ চেষ্টা করছে
বসে যাওয়া রথের চাকা তোলার
তুই ওকে সাহায্য কর, যুদ্ধে অধর্ম না হয়




যুদ্ধনদী- ৮

চার দেওয়ালে বন্দি থেকে
কবিতা লেখা যায় না
জীবনে একটা অন্তত সার্থক কবিতা লিখবো
শুধু তোর জন্য
আমার এই উড়োচিঠিগুলো, ঠিকানাবিহীন
তুই বললি পাণ্ডুলিপি
কিন্তু কেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াস?
আমি তো তোকে ভালোবাসি না!
এক জীবনে এত ঋণ?
উত্তরে তুই হেসেই পাগল
                                 বললি,
তোর শরীর মন সবটুকু তুলে রাখ
ভালো বর আর স্নেহ করা প্রেমিকের জন্য
আমায় শুধু ঘাড়ের তিলটুকু দিস
কোথায় পাস এতো জোর?
আমি তো পারি না কামনা বাসনা ফুল প্রজাপতি থেকে বেরিয়ে এসে একটা সার্থক কবিতা লিখতে।




যুদ্ধনদী- ৯

গঙ্গার ঈশান কোণে তোর আমার
                                        মুখোমুখি যুদ্ধ
তুই আমি গঙ্গা তিনজনেই পরোয়া করি না
সততা আর সতীত্বের
ওসব জং ধরা টিনের তলোয়ার
মারতে বা মরতে কোনোটাতেই কাজে লাগে না
তোর বুকে বন্দুকের নল
                              আমার হাতে ট্রিগার
তুই চাইলে এখুনি আমার উচ্ছিষ্ট ছুঁতে পারিস
তুই চাইলে এখুনি আমার অন্ধকারে জোনাকি
                                                       ছাড়তে পারিস
তুই চাইলে আমার অসম্ভবে
                      ফুল ফোটাতে পারিস
                              ফল ধরাতে পারিস




যুদ্ধনদী -১০

তোর শহরে শীতবৃষ্টি
তোর বুকেতে রজনীগন্ধা
আমার বুকে মহুয়া পলাশ
আমার শহর অলকানন্দা

তোর জন্মে মধু মিষ্টি
তোর চোখেতে আগুন
আমার জন্মে তেঁতুল গোলা
আমার চোখে ফাগুন

তোর চালে মন্ত্রী ঘোড়া
তোর ঠোঁটেতে বিষ
আমার চালে ভাঙা নৌকা
আমার ঠোঁটে কাঁচা ধানের শীষ

আমার শহরে কলমিকাঁটা
যুদ্ধনদী রক্ত বয়ে যাক
তোর শহরে মাধবীলতা
শান্তিসুখ চিরস্থায়ী পাক।





যুদ্ধনদী- ১১

এখন কুয়াশা মাস
তাই এতো অস্পষ্টতা তোকে ঘিরে
আমিও কাঁটা তুলতে গিয়ে
তোর ফুল ছুয়ে ফেললাম ভুল করে
বৃষ্টিমাসে সব ধুয়ে মুছে যাবে
তুই আবার সরল হবি
ততদিন যুদ্ধনদীর বুক হাঁতড়ে
আমি গুগলিগুলো তুলে রাখি





যুদ্ধনদী -১২

এক তিল ভালোবাসা চেয়েছিলাম
একটু একটু করে বহুযত্নে সঞ্চিত
স্বপ্নগুলোর জন্য একজোড়া
                          পাখনা চেয়েছিলাম
প্রতারক স্বপ্নগুলো পাখা পেতেই উড়ে গেল
এখন শূন্য খাঁচা, বত্রিশ ইঞ্চি বুক
ছেঁড়া পালকের বৃন্তে এক তাল রক্ত
ভিড় ঠেলে একলা হতে চাইছে

















Comments

  1. প্রতিটি কবিতাই খুব নিপুণভাবে পরিবেশিত হয়েছে। যেমনি তার বিনুনি, তেননই তার অন্তর্নিহিত অর্থ। যদিও একটি মানুষের নামে প্রতিটি কবিতা কিন্তু কখনো মনে হয় যেন তা আলাদা আলাদা মানুষের গল্প। আমি জানি না অনন্য কে তাই বক্তব্য রাখাও খুব কঠিন হচ্ছে। তাই প্রত্যেকটি অনন্যসুন্দর কবিতার জন্য আলাদা করে মন্তব্য করি।

    যুদ্ধনদী -১

    "এক জোড়া পানকৌড়ি আর নি:সঙ্গ ঝিঁঝিপোকা" - এখানেই কবিতার বক্তব্য সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
    এই কবিতায় ফুটে উঠেছে এক না পাওয়ার ভাবনা, এক অপূর্নতা আর ফ্যানের তিনটে ব্লেড।

    যুদ্ধনদী -২

    এটি অসম্ভব সুন্দর এক প্রেমের কবিতা যেখানে একসাথে বাসা বাঁধে কাম, ভালোবাসা ও লজ্জা।

    মনের ভিতরে ইচ্ছা
    মুখের ওপরে লজ্জা
    প্রেমে মিলাও
    জগতে বিলাও,
    দাও দাও প্রেমিকে, দাও প্রেমকে
    ভালোবাসা নিয়ে সকলেরে দাও চমকে।

    যুদ্ধনদী -৩

    পড়ে মনে হল এই কবিতা আর আগের কবিতার অনন্য আলাদা। এই কবিতার শেষ লাইন অপরিসীম সুন্দর। রবি ঠাকুর এর উপন্যাস এর ক১৯ বা চ৯ নয় এখানে গোটা উপন্যাস টার যেন সারসংক্ষেপ হয়ে গেছে।

    যুদ্ধনদী -৪

    এই কবিতার মর্মার্থ অনেক টা গুচ্ছ কবিতা র ২ নং কবিতার মত। সুন্দর বর্ণনা ও সাথে সাধারণ জীবন থেকে তুলে ধরা অসাধারণ শব্দভাণ্ডার। এই কবিতার ক্লাইম্যাক্স ঠিক যেন (উহ্য) - এর মত। পরে না হয় আপনার অনুমতি পেলে বলব।

    যুদ্ধনদী -৫

    এই কবিতা পুরোপুরি কামনির্ভর কবিতা যেখানে আপনি সুন্দর ভাবে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে আরো রমণীয় করে তুলেছেন। শেষটা কি Irony?

    যুদ্ধনদী -৬

    এই কবিতাটি বাকিগুলোর থেকে অনেক টাই আলাদা। লেখার মর্মার্থ উদ্ধার আমার মত সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কিছুটা মনসবিজয় কাব্য ও কিছুটা একটা সদ্য জনপ্রিয় বাংলা গানের কথার ওপর কথকতা করে হয়েছে মনে হয়। আশা করি গানটি সাহিত্যিক এর খুব প্রিয়। আমার ও খুব প্রিয়।

    যুদ্ধনদী -৭

    এই কবিতার দুটি মানে হয়-
    ১ দেখা গেল এক অনন্য কে আহ্বান জানানো হচ্ছে আরেক অনন্যের নিশান তুলে দেবার জন্য।
    ২ নিজের সন্তানলাভের প্রকট চেষ্টা।

    কোনটা ঠিক নাকি অন্য কোন মানে, আমায় জানাবেন দয়া করে।

    যুদ্ধনদী -৮

    আপনার প্রায় প্রতিটি কবিতাই সার্থক কবিতা। এই কবিতার অনন্য আলাদা। এ আপনার কবিতার প্রেরণা । আরেকটি অনন্য ও এখানে অবস্থান করে আপনার মননে। তার সঙ্গে আপনি আছেন। এত চরিত্র সামলে একটি কবিতা যদি সার্থক কবিতা না হয় তবে কোনটি সার্থক কবিতা?

    যুদ্ধনদী -৯

    এটি আরেক অনন্য এর গল্প। যে আপনার জীবনে থাকে না কিন্তু তাকে নিয়ে জীবন সাজাতে চান। যদি সত্যি প্রেম বলে কিছু থাকে তা আপনি দিয়েছেন এই অনন্য কে।

    যুদ্ধনদী -১০

    এই কবিতা কোন অনন্য এর বিয়ে নিয়ে যাতে আপনি ঘোর দুঃখিত। এই কবিতা মনে করিয়ে দেয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর রাধা বিরহ পর্বের কথা।

    যুদ্ধনদী -১১

    কবিতায় লেখা অস্পষ্টতার মত এই কবিতার মানেও অস্পষ্ট। কেবল মনে হয় যে একটা ভুল হয়েছিল যা আপনি শুধরে নিয়েছেন। এই অনন্য কি আপনার অপছন্দের অনন্য।

    যুদ্ধনদী -১২

    এই কবিতার প্রতিটি অনন্য উপস্থিত। কেবল অনুপস্থিত আপনার প্রেম। কবিতাটি খুবই সুন্দরভাবে লেখা। শব্দের ব্যবহার অসাধারণ।

    --
    আপনার আস্কারা পেয়ে অনধিকার হয়ত অনেক কথা বলে ফেলেছি যা বলা আমার উচিত হয়নি। দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন বা শাসন করবেন।
    ভাল থাকবেন। লিখতে থাকবেন।

    ReplyDelete
  2. এভাবে এতো সময় নিয়ে,
    আমার প্রতিটা কবিতা বিশ্লেষণ করার মতো আমার যে কোনো পাঠক আছে তা আমি সত্যিই জানতাম না। জেনে ভালো লাগলো।
    আজ মনে হচ্ছে আপনার মতো একজন পাঠক পেয়ে আমার ব্লগ তৈরিটা সার্থক।

    ভালো থাকুন, পাশে থাকুন💐

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিচ্ছেদের কবিতা

কবিতা

পাখির কাছে স্বীকারোক্তি

বিষণ্ণতার গল্প

জীবনের কবিতা

ভাঙন

আধুনিক কবিতাগুচ্ছ

প্রেমের কবিতা

বৃষ্টি কুঁড়িগুলো ফুটবে