গুচ্ছ কবিতা





বর্গী এল


গ্রামের কাঁচা রাস্তা ভোট চেনে না শুধু বোঝে নির্বাচনী উৎসব এলে সেরে ওঠে নতুন মোরামে
খেত মজুর কেজো প্রার্থী চেনে না , বোঝে ফসল ফললেই ভরবে মরাই ।

সময় চলে যায়। রাজনীতির ধর্ম বদলায়
হারান মন্ডল ভোট বুথে গিয়ে দেখে তার ফসল ফলানোর অস্ত্র নেই, এক খানিও ধানের শীষ অবশিষ্ট নেই বোতাম মেশিনে।
জোট বেঁধে ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে তার দো ফসলা ধানি জমি তবুও বহু মজুর পঁয়ত্রিশ বছরের অভ্যাসে কুপিয়ে গেছে বন্ধ্যা মাটি, হাতে তুলে নিয়েছে কাস্তে হাতুড়ি। সে জানে রক্তে বিষ না মিশলে তার রঙ লালই থাকে।







রবীন্দ্রনাথ ও না-সুখ

                   
রবীন্দ্রনাথ আসলে একটা আদর্শ-পাথর, মানুষ না
মানুষ পরশ পাথর খোঁজে আর আমার মত না-মানুষরা আদর্শ-পাথর !
পাথরের কান আছে আর আছে কান্না ,পাথরের অন্তর নেই , ওর অন্তঃস্থলের অন্তর্গত পাষাণগুলো জমাট বাঁধা পিশাচ যেন !
রবীন্দ্রনাথ আসলে বোগাস !
যক্ষপুরীর রাজা আসলে এক পেয়ালা বিষ, উদগ্র নীলাচ যার রঙ !
রবীন্দ্রনাথ কোথাও বলেননি কিন্তু আমি জানি রাজার একটা সত্যিকারের অসুখ ছিল
সেই অখুখের নাম না-সুখ ,
রবীন্দ্রনাথ বরাবর আমার অনুভূতিকে শীল নোড়ায় পিষেছে , যখনই ভেবেছি রতন সুখী হোক
তখনি উনি বলেছেন না সুখ আসলে পাথর ,
দুঃখ হল কাঁচা ফসল , তোমাকে প্রেমের মত নরম
কাদায় বীজ বুনতে হবে ,তোমাকে নর্দমার মত অন্ধকারে সংসার করতে হবে , শীত ফুরিয়ে গেলে সব ডালিয়া গাছ উপড়ে ফেলে , শুকনো ডালিয়া ফুলের পাপড়ি পচিয়ে জৈব সার বানাতে হবে
যেন বসন্তে তা থেকে আদর্শ গোলাপ ফোটে






উপহার


তুমি বাড়িতে ছিলে না
নিজের শহর ছেড়ে দূরে গেছো
আমি কেঁদেছি, হাত পা ছুঁড়ে কেঁদেছি
যেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে
কিন্তু তুমি তো কখনোই আমার কাছাকাছি থাকোনি
তোমাকে তো আমি প্রিয় দূর বলেই ডাকি
তবুও আমি জানি তুমি নিজের বাড়িতে আছো
চেনা বইগুলোই আঙুল বোলাচ্ছ
ডাইনিং টেবিলে বসে পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে দুপুরের ভাত খাচ্ছো, তোমার বাহন বলতে সেই রঙচটা বাইক
ওটাতে চেপেই ঘুরে বেড়াচ্ছো উঁচু নিচু টিলার ওপর দিয়ে , দেখে বেড়াচ্ছো গ্রাম গঞ্জের শুখা মাঠ
একা একাই ভাবছো প্রতি বছর বর্ষা আসে
সমভূমি সজল হয়
কিন্তু মালভূমির বুকে বড় তৃষ্ণা
পাথরে জল পড়া মাত্রই টিলাগুলো বড় বড় জিভ বার করে সব শুষে নেয় দানবের মতো।
তোমার এই অদ্ভূত চলাফেরা আর ভাবনাগুলোর সাথে আমি নিজের অভ্যাসগুলোকে গুছিয়ে নিয়েছি ভাঁজ করে তাই তুমি দূরে চলে গেছো দেখে আমি বর্ষার মতো অনর্গল কেঁদেছি। এক সময় কান্না থেমেছে এই ভেবে তুমি দূরে গেলেও আমার জন্য সুগন্ধী উপহার আনবে। উপহারে নাকি অনুভূতি জড়িয়ে থাকে
অচেনা শহর সমুদ্র পারে তুমি একলা
আমি দিন গুনি, উপহার হাতে তোমার ফিরে আসার
নিদেনপক্ষে তোমার পায়ের ছাপ পরা একমুঠো সিক্ত বালি

কাজ ফুরালে তুমি আসো, আমার কাছে নয়
তোমার সেই নিভৃত বাড়িটিতে
তুমি সবার জন্য কিনে এনোছো কত কি !
আমার জন্য কি কিনবে বুঝতে পেরে তুলে এনেছ
এক জোড়া মোজা
তুমি ভুলে গেছ আমার পা নেই থাকলে
কবেই হেঁটে যেতাম তোমার দরজা অবধি



লাল সাদা চোখ


প্রতি বাড়ির প্রতি পরিবারের একটা শব্দ থাকে
যা তার নিজস্ব শব্দ‌
প্রতি গৃহকর্তার দুটো চোখ থাকে
কারো চোখ ম্রিয়মান ঘোলাটে বরফের মতো
এরা স্ত্রীর আঁচড়, ছেলের থাবা সয়ে নেয় বেমালুম
কারো চোখ টকটকে লাল যেন রক্ত ঝরবে এখুনি
বিধাতা এদের সহ্য ক্ষমতা দেয়নি একদম
ভাতের পাশে মায়ের নুন দিতে ভুলে যাওয়া,
মেয়ের অঙ্কে নম্বর কম পাওয়া সবেতেই গর্জে ওঠে সিংহের মতো

প্রতিজোড়া চোখের একটা নিজস্ব রঙ থাকে
প্রেতযোনির মতো চিৎকার শুনি
চোখের ভিতর থেকে কারা যেন পিণ্ড চায়!




কাপ-প্লেট


আমি ঘুমাইনি। ঘুমাইনি কালিংপঙ। ঘুমাইনি একবিংশ শতাব্দীর বর্ষা। ঘুমাইনি বিচ্ছেদের রজনীগন্ধা। অন্ধকারে শুধু চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে, ঘনিয়ে আসে তরল রাত। কিছুতেই দেখতে পাই না বিশ্বচরাচর, এমনকি নিজের ভিতরটাও। চারিদিক গহীন কালো।
সার্চ লাইট ফেলে ফেলে খুঁজি আকাশের পূব দিক। জানি পাখিদের ডানায় ভর করে পাহাড়ের কোলে ওই দিকেই নেমে আসবে 'শুভ প্রত্যূষ'


তুমি কার্সিয়াং-এ খাদের ধারে ঝুলন্ত বাংলোয় পায়চারি করছো। হাতে চায়ের কাপ থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে কুয়াশার মতো। তোমার ব্যালকনি জুড়ে সাজানো অর্কিড। তোমার প্রিয় ফুল সিম্বিডিয়াম। কোনোটা দেখতে তোমার কবিতার মতো গোলাপি, সাথে গায়ে লাল লাল রক্তের ছিটে। কোনোটার সৌন্দর্য তোমার গানের মতো যেন নুঁইয়ে পড়া গাছের ডালে শিস দিচ্ছে মাছরাঙা, কোনোটা তোমার আভিজাত্যের মতো সুদৃশ্য পাপড়ি মেলা ককটেল চায়ের কাপ‌।



বিজ্ঞাপন
       

প্রথম সকাল। সূর্য এইমাত্র সোনার জলে মুখ ধুয়েছে। আকাশের পূর্বদিকে ডালপালা মেলে দিয়েছে রোদলতা। গত রাতের ঝড় বৃষ্টি দমাতে পারেনি বাবুই পাখিটাকে তাই সে সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘরামি হয়ে সারাই করছে নিজের ভাঙা বাসা।

এমন সময় মুখ পুস্তকে চোখ মেলে পৃথিবীর প্রাক্তন মা দেখলো, সদ্য মাতৃহারা বাচ্চাটির নাক মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত ঝরছে।

পাঁজরের শুকনো নদীখাতে ঝোড়ো হাওয়ার সাথে মমতার একটা ক্ষীণ স্রোত বয়ে গেল। কারা যেন বিজ্ঞাপন দিয়েছে- 'আত্মীয়-র সন্ধান চায়'








Comments

  1. দুর্দান্ত কয়েকটি কবিতা। ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন ভাবের। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদিত পাষাণ ও রক্তকরবীর ছায়া দিয়ে শুরু করে নিজের একেকটি অসামান্য লেখা।
    'কাক কোকিলের কে' এবং 'উপহার' লেখা দুটো অনবদ্য।

    এরকমই ভাল ভাল লেখা দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করবেন আশা রাখি। ভাল থাকবেন। সুখে থাকবেন। লিখতে থাকবেন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিচ্ছেদের কবিতা

কবিতা

পাখির কাছে স্বীকারোক্তি

বিষণ্ণতার গল্প

জীবনের কবিতা

ভাঙন

আধুনিক কবিতাগুচ্ছ

প্রেমের কবিতা

বৃষ্টি কুঁড়িগুলো ফুটবে