যুদ্ধনদী এবং অনন্য




'যুদ্ধনদী এবং অনন্য' আমার লেখা প্রথম কবিতাগ্রন্থ।
এটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ১১ই জানুয়ারী কলকাতা লিটিল ম্যাগাজিন মেলায়। প্রকাশক- 'পথের আলাপ'। এটি কোনো বানিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থা নয়।এই নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে। সেই পত্রিকার বইমেলা সংখ্যার সাথে সম্পাদক অতি যত্নে আমার এই বইটি এবং অন্যান্য বই প্রকাশ করেন। এই বই এর প্রতিটি কবিতাই ২০১৬ সালের লেখা। 'যুদ্ধনদী এবং অনন্য'র মূলাধার হলো প্রেম। প্রেমকে ঘিরেই  সৃষ্টি হয়েছে জগৎ, যেখানে কল্পনা রয়েছে, আবেগ রয়েছে আর রয়েছে প্রিয় এক মানুষকে না-বলা সহস্র কথা।আবেগসর্বস্ব হওয়ায় এই বই এর আর কোনো সংস্করণ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত আমি নিইনি।

যুদ্ধনদী সিরিজের কবিতাগুলো এই ব্লগে প্রকাশ করা হলো। পরবর্তীকালে অনন্য সিরিজের কবিতাগুলিও পরিমার্জিত করে সংযোজিত হবে। আপাতত যুদ্ধনদী পাঠক স্পর্শ পাক।





যুদ্ধনদী




অস্থি মজ্জার সবটুকু রস নিংড়ে
তোর জন্য একটা নদী বানিয়েছি
ভালোবাসাগুলো গড়িয়ে দিয়েছি
            সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে

আমার বাড়ির সামনে
ধূ ধূ নকসী কাঁথার মাঠ
রক্ত পায়ে হেঁটে চলে
দলছুট গঙ্গা ফড়িংয়ের দল

অমাবস্যার অন্ধকারে
ডুব সাঁতার দিচ্ছে একজোড়া পানকৌড়ি
জামরুল বনে কাঁদে
নিঃসঙ্গ ঝিঁঝিঁ পোকা

তুইহীন আমার ড্রয়িং রুম
সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে
আমি তোকে খুঁজছি
শহরের আলো আঁধারে

আবার যুদ্ধ, আবার বিস্ফোরন
নির্বাক হিরোসীমা
লেকের ধারে দুটো ঠোঁট
জলে ছায়ার ছোঁয়াছুঁয়ি ।




 ২

সকালের কুয়াশায় তোকে প্রথম দেখলাম
আগুন্তুকের মতো হাঁ করে তাকিয়ে ছিলিস
চোখে আগুন অথবা ফাগুন
                        কিছু একটা অন্যরকম ছিল
তাই চোখ মেলাতে পারিনি চোখ
তুই শূন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলিস,
কিচ্ছু চাই না শুধু আঙুলের ফাঁকগুলো
ভরাট করে দে
আমি হেসে তোকে এড়িয়ে গেছলাম
তবুও তুই হাতটা সরিয়ে নিসনি
স্টেশনের ভিখিরিগুলোর মতো একই ভাবে
পেতে রেখেছিলিস
আমি পুড়ছিলাম,
লজ্জা নামের ক্ষীণ এক আগুন
প্রদীপের মতো আলোকিত করছিল আমাকে
মাথার ওপর এক ঝাঁক শালিক ঝগড়া করছিল
আমার ইচ্ছে করছিল,
এখুনি সীতার মতো পাতাল প্রবেশ করি
অথবা এক দৌড়ে চলে যায় নির্জন কোনো গাছতলায়
ব্যাণ্ডেল কাটোয়া লোকালটা আমাকে বাঁচিয়ে দিল
তুই ছোটো হতে হতে এক সময় মিলিয়ে গেলি






আমি ভালোবাসি রক্তকরবী
আমার মননে রঞ্জন, আমার যাপনে রঞ্জন
তুই তো রঞ্জন না, তুই রাজাও না!
তুই বিশুপাগল, তুই আমার প্রকার
তোর মধ্যে দিয়ে আমি বাহিরকে দেখি
তুই তো গান গাইতেও জানিস না
সুর-তাল-লয় এগুলোর মানে বুঝিস?
তুই যাচ্ছেতাই রকমের হ্যাংলা
তীর্থের কাকের মতো সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকিস
আমার যুদ্ধনদীর পাহারাদার হয়ে
কেউ তোকে আগে বলেছে?
তোর পাগলামি অসহ্য রকমের!
কেবল তোর অগোছালো শব্দমালা
অনাবিস্কৃত গালি আমাকে কবিতা লেখায়
তুই নন্দিনী বলে যখন বার বার ডাকিস
আমি তখন শ্রাবণমাসের অপ্রতিরোধ্য পদ্মা
ঝুপ ঝুপ করে ভাঙি, কেবল ভাঙি
                                        আবার ভাঙি






তোর প্রেমিকার পাতলা ঠোঁট
                     তোর ভরাট চুমু
কুলোয় না ওর ঠোঁটে
তোর বৌয়ের মোটা ঠোঁট
ওর চুমুর স্থানাভাব তোর ঠোঁটে
আমি প্রচণ্ড শীতেও শুষ্ক রাখি ঠোঁট
                                     ভেসলিন মাখি না
কারণ তোকে খেতে যাওয়া
অনভ্যাসের প্রথম চুমুটা
যেন ভেসলিনের প্রলেপে পিছলে না যায়







তোর বোতামের নীচে একটা ঝর্ণা
           সারাদিন ঝির ঝির
    ঝাউবন পেরিয়ে বয়ে চলেছে
        ব্লাউজ উপত্যকার দিকে

তোর নাভিমূলে সৃষ্টির বীজ
                   আরো নীচে মৌনালোয়া
আমার গর্ভ ধানের গোলা
 আরো নীচে পোষা নদী

চল্ প্রতিদ্বন্দ্বী হই
তলোয়ারের আঘাতে আঘাতে
বুকে আঁকি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত







শীতের দুপুর খোলা ছাদ
সাপ লুডোতে কিস্তিমাৎ
আমার জন্য স্বর্গের সিঁড়ি
তোর জন্য সাপের ছোবল
আমার জন্য পুট ছক্কা
তোর জন্য মনসামঙ্গল

আমার নদীতে জোয়ার এখন
তোর বুকেতেই আঁছড়ে পড়ি
বাঁচার মতো বাঁচার হলে
চল্ যুদ্ধের পাঠটাই মুখস্থ করি।







বড়দিনের ছুটিতে একটা ছোট্ট ট্যুর হওয়া চাই
                                        পাহাড় কিংবা সমুদ্র

হোটেল নামি কমদামি যেমনই হোক
একটা স্লিভলেস রাতপোষাক চাই
চাকুরিজীবি বিবাহিত দম্পত্তিদের
একটি বিশেষত্ব হলো,
এরা শুধু নিজের বিছানায় মরে না
প্রথম সহবাসের মোহে এরা
                     দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ট্যুর করে
পাশের বাড়ি আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে
এদের শুধু একটা বিছানা চায়
তাহলেই হাসিমুখে আত্মহত্যা

আমি তোকে এই জীবগুলোর থেকে আলাদা ভাবি
জানি শরীর তোর কাছে চৌকাঠ
                            আত্মায় প্রবেশের দ্বারমাত্র

আমার স্তনবৃন্তে বন্দি যে চড়ুই
তোর আঙুলে ওর মুক্তি লেখা হোক
নীল আকাশে উড়িয়ে দে ওর পালক
আমার স্নানের ঘরে আজন্ম বাঁধা আছে
                                                     এক নদী
সে নদীপথে এখন কুরুক্ষেত্র
গভীরে প্রবেশ করে দ্যাখ,
অসহায় কর্ণ আজো প্রাণপণ চেষ্টা করছে
বসে যাওয়া রথের চাকা তোলার
তুই হাত লাগা, যুদ্ধে যেন অধর্ম না হয়






চার দেওয়ালে বন্দি থেকে
কবিতা লেখা যায় না
জীবনে একটা অন্তত সার্থক কবিতা লিখবো
শুধু তোর জন্য
আমার এই উড়োচিঠিগুলো, ঠিকানাবিহীন
তুই বললি পাণ্ডুলিপি
কিন্তু কেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াস?
আমি তো তোকে ভালোবাসি না!
এক জীবনে এত ঋণ?
উত্তরে তুই হেসেই পাগল
                                 বললি,
তোর শরীর মন সবটুকু তুলে রাখ
ভালো বর আর স্নেহ করা প্রেমিকের জন্য
আমায় শুধু ঘাড়ের তিলটুকু দিস
কোথায় পাস এতো জোর?
আমি তো পারি না কামনা বাসনা ফুল প্রজাপতি থেকে বেরিয়ে এসে একটা সার্থক কবিতা লিখতে।






গঙ্গার ঈশান কোণে তোর আমার
                                       মুখোমুখি যুদ্ধ
তুই আমি গঙ্গা
তিনজনেই পরোয়া করি না সততা আর সতীত্বের
ওসব জং ধরা টিনের তলোয়ার
মারতে, মরতে কোনোটাতেই কাজে লাগে না
তোর বুকে বন্দুকের নল
                              আমার হাতে ট্রিগার
তুই চাইলে এখুনি আমার উচ্ছিষ্ট ছুঁতে পারিস
তুই চাইলে এখুনি আমার অন্ধকারে জোনাকি
                                               ছড়াতে পারিস
তুই চাইলে আমার অসম্ভবে
                         ফুল ফোটাতে পারিস
                                 ফল ধরাতে পারিস




১০

তোর শহরে শীতবৃষ্টি
তোর বুকেতে রজনীগন্ধা
আমার বুকে মহুয়া পলাশ
আমার শহর অলকানন্দা

তোর জন্মে মধু মিষ্টি
তোর চোখেতে আগুন
আমার জন্মে তেঁতুল গোলা
আমার চোখে ফাগুন

তোর চালে মন্ত্রী ঘোড়া
তোর ঠোঁটেতে বিষ
আমার চালে ভাঙা নৌকা
আমার ঠোঁটে কাঁচা ধানের শীষ

আমার শহরে কলমিকাঁটা
যুদ্ধনদী রক্ত বয়ে যাক
তোর শহরে মাধবীলতা
শান্তিসুখ চিরস্থায়ী পাক।




১১

এখন কুয়াশা মাস
তাই এতো অস্পষ্টতা তোকে ঘিরে
আমিও কাঁটা তুলতে গিয়ে
তোর ফুল ছুয়ে ফেললাম ভুল করে
বৃষ্টিমাসে সব ধুয়ে মুছে যাবে
তুই আবার সরল হবি
ততদিন যুদ্ধনদীর বুক হাঁতড়ে
আমি গুগলিগুলো তুলে রাখি




১২

এক তিল ভালোবাসা চেয়েছিলাম
একটু একটু করে বহুযত্নে সঞ্চিত
স্বপ্নগুলোর জন্য একজোড়া
                          পাখনা চেয়েছিলাম
প্রতারক স্বপ্নগুলো পাখা পেতেই উড়ে গেল
এখন শূন্য খাঁচা, বত্রিশ ইঞ্চি বুক
ছেঁড়া পালকের বৃন্তে এক তাল রক্ত
ভিড় ঠেলে একলা হতে চাইছে












Comments

  1. প্রতিটি কবিতা প্রাণশক্তিতে ভরপুর

    ReplyDelete
  2. যুদ্ধনদী দেখে ভাবলাম যুদ্ধের কবিতা হবে, কিন্তু এ তো নিখাদ প্রেমের কবিতা। প্রতিটা কবিতাই প্রেমময়, পড়ছি আর ভাবছি মানুষ এত গভীরভাবে কী করে ভালবাসে? ২,৩,৪,৭,৯,১০ সব কটা কবিতাতেই প্রেম উপছে পরছে। আশা করি এগুলো আপনার জীবনের গল্প থেকে সমৃদ্ধ। যদি না হয় তা হলে বল্ব আপনাকে অবিলম্বে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত, 'feelings' - কে এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করার জন্য। আপনার লেখা পড়ে আমি প্রতিবার ই মুগ্ধ হই, এতদিন পরেও পেলাম সেই মুগ্ধতা।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিচ্ছেদের কবিতা

কবিতা

পাখির কাছে স্বীকারোক্তি

বিষণ্ণতার গল্প

জীবনের কবিতা

ভাঙন

আধুনিক কবিতাগুচ্ছ

প্রেমের কবিতা

বৃষ্টি কুঁড়িগুলো ফুটবে