আবৃত্তির কবিতা
ক্ষুধার্ত
ট্রেনটা ছুটছে। ট্রেনের জানলার জং ধরা অযত্নের রেলিং। সেই রেলিং এর ফাঁক দিয়ে আমি শ্রাবণের রোদ দেখছি। গ্রাম গঞ্জ দেখছি। সব থেকে বেশি দেখছি তা হল মাঠ-ঘাট গাছেদের ব্যস্ততা। এ বছর বর্ষা দেরি করে এসেছে তাই সদ্য শুরু হয়েছে রোয়ার কাজ। রোয়া দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় প্লেট থেকে উঠতে থাকা গরম ভাতের ধোঁয়ার গন্ধ। এই ধোঁয়া খেলেও আমার পেট ভরে যায় অনেকখানি। নাক পেতে দিই উদ্বায়ী ধোঁয়ার গতিপথে। আহ! কি সুন্দর গন্ধ। কিন্তু এই গন্ধটা পালটে যায় সময় সময়।
আমি যখন বাবার বাড়ি যাই, মা ভাত বেড়ে দেয়। ওই প্লেট থেকে যে ধোঁয়া ওঠে ওতে নাক গুজলেই গন্ধ পাই ছেলেবেলার। পাঁক ঘেটে তুলে আনা চুনো মাছের বাটি চচ্চড়ি, বিউলির ডালে হিং মৌরি ফোড়নের গন্ধ। পেট ভরে যাই গন্ধে। আমার পাতের ভাত পাতেই পড়ে থাকে। আবার যখন বিয়ে বাড়িতে খেতে বসি তখন ভাতের ধোঁয়া থেকে ফুলের গন্ধ বের হয়। ফুলের গন্ধে আমার ঘুম পাই। খিদে মরে যায় তাই নেড়ে চেড়ে উঠে পড়ি মাঝপথে। হব্বিষ্যির ভাতের যে ধোঁয়া তা থেকে শোকের গন্ধে বেরোয়, অস্থির করে তোলে আমাকে। শোক চ্যুইনগামের মতো, চেবানো গেলেও গেলা যায় না। তাই আমার গলা দিয়ে নামে না হব্বিষ্যি, অভুক্ত থেকে যাই।শশুরবাড়ির ভাতের প্লেট। ধোঁয়া ওঠে পাক খেতে খেতে। নাক পাতলে গন্ধ পাই তাচ্ছিল্যের। খেতে পারি না ভাত, আঙুল দিয়ে আঁক কাটি। এক সময় ভাত জুড়িয়ে যায় তবুও গন্ধ ছেয়ে থাকে ঘরময়। সারা বেলা ক্লান্তির পর দুপুরে স্কুলের স্টাফরুমে বসে ভাতের টিফিন কৌটো খুলি। তখনও ধোঁয়া ওঠে টিফিনের মুখ থেকে। নাক পাতলে দেখি উগ্র ঘামের গন্ধ। ওয়াক ! আমার বমি পাই। টিফিনের মুখ বন্ধ করে ছুটে যায় বেসিনে। খিদে মেটে না, রয়ে যায় অনন্তকাল। ধিম ধিম করে পেটের ভিতর, মাথার ভিতর।
কালেভদ্রে তোমার সঙ্গে দেখা হয়। রেষ্টুরেন্টে বসি।টেবিলে ফুলদানি, ঝলমলে আলো। বেয়ারা ভাতের প্লেট নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। তুমি নিজে সার্ভ করো।
ভাতের প্লেট থেকে ধোঁয়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মৃদু আলোতে। যেভাবে ধূপের ধোঁয়া ছড়ায় ঠিক সেভাবে। আমি নাক পাতি, আরো একাগ্র ভাবে নাক পাতি। না গন্ধ নেই ! কোনও গন্ধ নেই!
এও কি সম্ভব? নিবিড় ভাবে শুঁকি। না না !
কোনো গন্ধ নেই। খিদেটা পেটের ভিতর ধিম ধিম করে।
আমি ডাল দিয়ে ভাত মাখি। খাবলে খাবলে খাই।
তুমি তাকিয়ে থাকো অপলক, যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনও শিল্পের দিকে তাকিয়ে আছো। আমি বিরামহীন খেয়ে যাই। ডালের বাটি ফুরিয়ে গেলে তরি তরকারি, তারপর মাছ মাংস। গলায় কাঁটা বেঁধে, তুমি জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলো, আস্তে খাও। আমি কর্ণপাত করি না, খেয়ে যাই। খিদেটা গনগন করে জেগে ওঠে পেটের ভিতর, মাথার ভিতর।
আশ্চর্য প্রদীপ
প্রদীপ ঘষলেই একটা জিন বের হতো, আমার কান্নার সব নুনগুলো শুষে নিয়ে আবার প্রদীপের ভিতর ঘুমিয়ে যেত সে। এভাবে একদিন, একবছর
দুদিন, দুবছর
তিনদিন, তিনবছর
অনন্তকাল চলতে থাকলো।
এরপর বহু ঘষেও যেদিন প্রদীপের ভিতর থেকে জিন আর বের হলো না, কেউ বললো না 'হুকুম মেরি আকা' সেদিন আমি হতাশায় ভেঙে পড়লাম, খুউব কাঁদলাম টানা আটচল্লিশ ঘন্টা। তারপর ভিজে বালিস ছেড়ে উঠে নিজের চোখ নিজেই মুছলাম প্রথমবার। প্রদীপটাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরলাম খানিক, চুম্বন করলাম অনেক, বুঝলাম ভিতরে আর কেউ নেই, চারিদিক শূন্য কেবল মহাশূন্য। কান পাতলাম প্রদীপের বুকে সে কি গর্জন! আমার চোখের নোনাজলে তার ভিতরে এক সমুদ্র জন্ম নিয়েছে।
না
মায়ের মুখে শুনেছি,
প্রথম বার 'না' উচ্চারণ করেছিলাম
খাবার দিতে অস্বীকার করে। ভাই-বোন-আত্মীয় আমার অংশের ভাগ চাইলেই ঘাড় নেড়ে বলতাম নাঃ
সেই 'না' ছিল ধাতব, স্পষ্ট ঝংকারে কেউ সাহস পেত না আমার খিদে দখলের
বড় হয়েছি, এখন আমার সমস্ত 'না' জিভের নরম ছায়ায় ঘুমিয়ে গেছে অঘোরে তাই ক্ষুধার্ত আমি হাসি আর আমার ভাগ খেয়ে যায় বাঘের মাসি পিসি
প্রতিবিম্ব
একলা থাকি
সারাদিন জানলা বন্ধ
সন্ধেবেলা সরবে কবিতা পড়ি
পথ চলতি মানুষ তর্জনি উঁচিয়ে
বিড় বিড় করে বলে যায় দুর্বোধ্য
মেঝেতে খেতে বসি, একা
দৃশ্যটি আমার ভালো লাগে না
দ্রুত খাবার শেষ করতে তাই মুঠো মুঠো ভাত
গিলে নিই খাবলে খাবলে
খেতে বসে আজ প্রথম আয়নায়
চোখ গেল, কাঁচের ভিতর ফুটপাত
আঁৎকে উঠলাম! মনে হলো মানুষে
এভাবে খায় না
আত্মহত্যা
দেওয়াল বেয়ে এক সারি লাল পিঁপড়ে
দ্রুত চলে যাচ্ছিল খাটের তলায় অন্ধকারে
আমি পথ আঁকটাই, ও চেষ্টা করে ঘুর পথে যাওয়ার
আমি আবার ঘিরে ধরি
ওদের মধ্যে সব থেকে বেশিবার যে পিঁপড়েটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল আমি তার নাম রাখলাম আমার নামে পদবীও দিলাম পূর্বপুরুষের
কিছুক্ষন পর যত্ন করে দু আঙুল মানে বুড়ো আর তর্জনির মাঝে শোয়ালাম পিঁপড়েটাকে তারপর চোয়াল শক্ত রেখে টিপে টিপে মেরে ফেললাম
প্রিয় ঘুম
এমনিতে ঘুম আসে না, সাধনা করলে আসে
আমি সাধনা করি কারণ ঘুম আসার পর অসম্ভব রকমের সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়
আমার চেতনা নামের পোষ্যটা শীতলতায় ডুবে যায় অন্ধকূপে, রান্না আর খিদে থেকে ছুটি পেয়ে শরীরের
দরকারী স্নায়ুগুলোও ছুটে যায় ধানক্ষেতে
ঘুম এলে আমার ভিতরের সর্বজ্ঞ কবিটা চলে যায় মৃতের দেশে, খুঁজে নেয় লেট সব কবিদের মৃত্যুস্তূপ
দেখে প্রত্যেকেই মারা গেছে অতিশয় ভাবাবেগে
নীরবতা
ফোনের ওপারে তুমি
এপারে আমি স্বাভিমান হয়ে গেছি
মাঝখানে চুপচাপ তরঙ্গ
কথা কর্পূর, অসংরক্ষণে উবে গেছে কঠিন
নীরবতা দীর্ঘ হলে সম্পৃক্ত হয় ভাষা!
Comments
Post a Comment