বাংলা কবিতা

             

         বাংলা কবিতা



প্রহরী


পৃথিবী ঘুরছে না অনেক দিন ধরে, কথাটি সবার প্রথম কোপারনিকাসকে জানালাম, উনি মানতে চাইলেন না, বললেন অসম্ভব, ঝুটা খবর। তারপর গ্যালিলিওকে বললাম, উনি বললেন, "আমি এখন খুব ব্যস্ত, এবার কাছের জিনিসকে দূরে পাঠাতে হবে। দূরত্ববীণ আবিষ্কার করছি। ফর্মূলা রেডি কিন্তু কিছুতেই সরছে না বিষাদ, দুঃখদানি গুলো ভরে আছে নিশিফুলে।

আমি বললাম, পৃথিবী যে গোঁয়ার্তুমি করছে, সে খবর কেউ না। গ্যালিলিও বললেন,  দূরবীণে চোখ রাখো।

দূরবীণে চোখ রাখলে নলের ভিতর থেকে একটা সাপ আমাকে ছোবল মারতে আসে, আমি মুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিই। 

গ্যালিলিও চুপ, কোপারনিকাস চুপ

কেউ শুনছে না আমার কথা, ভাবছে ভুল বকছি কিন্তু আমি যে লক্ষ করেছি অনেকদিন ধরেই পৃথিবী বসে আছে জলার ধারে শ্মশানের ফাঁকা জমিটিতে। কেন যে মানুষ টের পায় না! আমরা না সজাগ হলে ও হয়তো জলার মৃদু মন্দ শীতল বাতাসে একদিন ঘুমিয়েই পড়বে।



অজাত


আমার হৃদপিণ্ডের ভিতর একহাঁটু জল। ঠিক ব্যাঙাচির মতো দেখতে একখানি কবিতা রোজ পোকামাকড় খাচ্ছে আর ফুলে ফেঁপে উঠছে। আমি অনুভব করছি আমি বদলে যাচ্ছি একটু একটু করে, ক্রমশ অন্য মানুষ হয়ে উঠছি‌। স্নায়বিক উত্তেজনা বাড়ছে ফলে মাটির ওপর পায়ের পাতার দখল কমছে। নিজের পা অথচ নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পারছি না আমি যেতে চাই পড়ার ঘরে, পা ভুল করে বার বার পৌঁছে যাচ্ছি পরিত্যক্ত কুয়োতলায়

                                             ঝুঁকে পড়ছি কুয়োর মুখে

জল নয়, ভিতরে চব্বিশ সেমি ব্যসার্ধের একখানি আকাশ শুকনো ডালপালা‌ থেকে পেণ্ডুলামের মতো দুলছে একটি চড়ুই গলায় দড়ি দিয়েছে বোধহয়।

ভয়ে আঁৎকে উঠি। দৌড়ে ফিরে আসি ঘরে। অসুস্থ বোধ করি। শরীরটা কেমন পালকের মতো নরম নরম মনে হয় যেন খুব যত্নে কেউ সেদ্ধ করেছে লবন সমেত

অস্থিরতায় রোজ বাথরুমের দরজা ভুল করছি তবুও না বমি করে, না প্রসব করে, কিছুতেই পৃথিবীর আলো দেখাতে পারছি না কবিতাখানিকে।


জনৈকা


জনৈক নারী আঁচলে কান্না বেঁধে বলেছিল নিয়তি মানি

কেন না অযোগ্যতা ছিল না কখনও

জল বিছিয়ে সম্পর্ক পেতেছি তবু হায় জলের আকাল !

এ কি নিয়তি নয়?

উত্তরে এক ঝাঁকড়া চুলওয়ালা বটগাছ হো হো করে হেসেছিল

বলেছিল, "বোকা মেয়ে নোনা জলে ঘর না হয় বাঁধবে কিন্তু পান করবে কী? মনে রেখো  অভাব না থাকলে স্বভাব বদলাতে নেই।"

মেয়েটি ভাবলো সত্যিই অভাব ছিল না বড়

যা ছিল তা দিয়ে অনায়াসে চলে যেত একটা জীবন

তবু কেন ভীমরতি?

এবার বটগাছের ফোকর থেকে মারাংবুরু মুখ বাড়িয়ে বললো, একঘেয়েমি বিস্বাদ লাগে, প্রতিটা রান্নার আলাদা মশলা জেনো।



প্রচ্ছনা


পৃথিবী, আমি একটুও অবাক হচ্ছি না তোমার লোলুপতায়। তুমি সর্বগ্রাসী, একে একে কেড়ে নাও সমস্ত সহজ সরল মানুষগুলোকে টোপ দিয়ে।  হ্যালোজেন ফেলে ঢেকে দাও ফুলের ব্যক্তিগত শুচিতা। 

যে মানুষগুলো ভালোবাসতো হাসতে, তারা আজ মঞ্চে দাঁড়িয়ে হি হি করছে। যে মানুষগুলো ভালোবাসতো একান্তে কাঁদতে তারা আজ মিটিংএ মিছিলে খুব ক্লান্ত।

পৃথিবী, কী পাও তুমি? সৃজনশীল বিষণ্ণ মানুষগুলোকে কাপ-প্লেটের লোভ দেখিয়ে! যে মানুষগুলো গান গাইতো বেসুরো, কবিতা লিখতো সিঁথির ছায়ায় তারা আজ ভীষণ ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। হাততালি, গ্ল্যামার কেড়ে নিচ্ছে আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় প্রেমিক।

পৃথিবী, এখনো বলছি, সাবধান, তফাৎ যাও! আমার হাতে আঁশ বঁটি, ওদের ছুঁলে এক কোপে ল্যাজা মুড়ো আলাদা করে দেবো।





নগরায়ণ


আজকাল যা দেখি সব ভালো লাগে

আলো আঁধার সব। দেখলাম, শূন্য মাঠের মধ্যে থেকে এক এক করে বাড়িগুলো গজিয়ে উঠছে, শহর হবে শীঘ্রই

তা ভালো, মানুষের পায়ের ছাপ পড়ুক, ভিড় বাড়ুক

গায়ে গায়ে চললে তবু যদি মানুষ টের পায় পাশের জনের জ্বর, জলপট্টি দরকার


শহরগুলো বড় হচ্ছে পিঠোপিঠি, কোনো বন্ধ্যা জমি আর ফাঁকা পড়ে থাকবে না। কেন না, মানুষ রুক্ষতা সইতে পারে না একদম, অক্ষমতার ভিতর হাতুড়ি চালিয়েই তার গৌরব





নদীর জন্মদিন


ঘুর্ণনরত বৃত্তের কেন্দ্রে মৃত্যুদিন ওঁৎ পেতে বসেছিল

শরীরে জড়ানো ইঁদুরের লোম। ক্ষুধার্ত দাঁতে কচি ধানের দুধ

জন্মদিন স্থির দাঁড়িয়েছিল সেপ্টেম্বরের ক্যালেণ্ডারে পাঁচের ঘরে। বৃত্ত ঘুরছিল চর্কির মতো, একবছর সময় নিচ্ছিল পাঁচের ঘরে ফিরে আসতে। চারের ঘরের মাঝরাত থেকে বৃত্তের দেওয়াল জুড়ে জ্বলে উঠছিল শয়ে শয়ে মোমবাতি

হঠাৎ...

পাঁচের ঘরে মাঝরাতে একটা দীর্ঘ ফুঁঃ

নিভে গেল মোমবাতি। ক্ষুধার্ত মৃত্যুদিন কেন্দ্র থেকে ঝাঁপ দিল বৃত্তের দেওয়ালে, ধারালো দাঁতে চিবিয়ে নিলো জন্মদিনের আলো


নদীর মৃত্যুদিন


আজকাল ধুমধাম করে আতসবাজি পুড়িয়ে সন্তানের জন্মদিন পালনের রেওয়াজ চালু হয়েছে। বিদেশিদের মত নরম কেকে আমরা অনায়াসে ছুরি চালাই, জানি এমন নরম তুলতুলে কেক কাটতে ছুরির দরকার নেই, যেমন সংসার ভাঙতে হাতুড়ি লাগে না, একটা আলপিনই যথেষ্ট তবুও এগুলোই নিয়ম, নিয়ম লঙ্ঘন করলে সমাজ পাপ দেয়। 

আমিও সমাজবদ্ধ জীব তাই জন্মদিন পালনের ছোঁয়াচে অসুখটা আমাকেও পেয়ে বসেছে কিন্তু সাবজেক্ট তো থাকতে হবে, সন্তান তো দূরের কথা পোষ্য কুকুর বেড়ালও যে নেই


আমার অবশ্য একটি নদীর মতো তিরতিরে মেয়ে ছিলো। বেঁচে থাকলে প্রতি বছর ওর জন্মদিন পালন হতো

 মৃত সন্তানের জন্মদিন হয় না ওদের একমাত্র মৃত্যুদিন


স্বপ্নের তিন পা

অসিত কাকু বলেছিল স্বপ্ন চলমান, অস্থির স্নায়ুর চাকায় ভর করে শরীরকে বয়। দেড় যুগ পেরিয়েছে, অসিত কাকু বেঁচে নেই। মুখটাও আর স্পষ্ট মনে পড়ে না, শুধু মনে পড়ে চশমার কাঁচটা হরলিক্সের শিশির মতো মোটা ছিল। আজ আমারও মনে হয় শরীর স্থবির আসলে স্বপ্নই শরীরকে গতি দান করে

ঘুমের ছায়ায়  স্বপ্নগুলো দ্রুত গতিতে চললেও কংক্রিটের

পথে তিন পেয়ে অটোর মতো অসহায়










শোঁয়া


আমার শিরদাঁড়া রসালো, এ বিষয়টি পূর্বজ্ঞাত। স্বপ্নে যেদিন প্রথম শোঁয়া লাগলো, সত্যি বলছি ঘুমাতে পারিনি সারা রাত শির শির করেছে মেরুদণ্ডের নালিপথ, নিজেকে সজনে গাছের মতো অসহায় মনে হয়েছিল


উসখুশ করেছি বিছানায়

পোকাগুলো জমাট বেঁধে ষড়যন্ত্র করছিল

কিভাবে আমার মতো মধ্যবিত্ত মেয়ের পাহাড় প্রামাণ মনোবল ভেঙে ফেলা যায়। আমিও চুপ করে পড়ে থেকেছি বালিসের পাশে বালিসের বোন হয়ে। ওরা কিলবিল করেছে, ঘাড় বেয়ে নেমে পড়েছে পিঠের প্রান্তরে, আমি  টুঁ শব্দ করিনি। তুমি চিনতে পারোনি, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সেদিনই চিনেছে আমায়

বুঝেছে, সঙ্গম তো দূর কি বাত ;

প্রেম ছাড়া আমি প্রণামও এড়িয়ে চলি




শিকড়


গাছেদের মন খারাপ হলে

                                আমার শ্বাসকষ্ট বাড়ে

বন্ধ দুয়ার খুলে দিই

      হাঁসগুলো ফিরে আসে ঘরে

ঠোঁটে করে বয়ে আনে

                        গুগলি আর কলমি শাকের স্বাদ

                 পালকে তখনো বাহিরের গন্ধ

         বুকে জলের শব্দ অগাধ

বিকেল ফুরোয়, বিষণ্ন চরাচর

গাছগুলো কাঁদে, ভিজে যায় মাটি

বাগান সাজাতে চেয়ে মৃত্যু কেন ডাকি?




নৌকাকৃতির বিষণ্ণতা


বিষণ্ণতা শুয়ে ছিল নদীর ওপর

আমি ভেবেছিলাম নৌকো

পার হতে হবে যৌবন, তাড়াও ছিল খুব

চেপেছিলাম তাই

বিষণ্ণতার পিঠ নড়ে উঠেছিল, বলেছিল সাবধান !

একলা এসো না, এখন নদীতে জোয়ার এরপর আবার ভাঁটা

জোয়ার-ভাঁটা দুইই পারাপারের অযোগ্য

কেউ দ্রুত বেশি, তো কেউ অতি ধীর

কিন্তু পার যে আমায়  হতেই হবে

আমি তোয়াক্কা করিনি, চেপে বসেছি টাল সামলে নিয়ে

তারপর রশি খুলে গেল

সমস্ত যৌবন কেটে গেল বিষণ্ণতায়

জলের ছাদ, জলের দেওয়াল, জলের মেঝে

জল ছাড়িয়ে আমার আর ডাঙায় ওঠা হলো না


চিনি



সংসারে নুন আছে

                     চিনির অভাব

অথচ নুন চিনি দুটোই এক ফর্দে আসে

মাসের প্রথম প্রথম

                                  নুনের ব্যবহার বেশি

                              অল্পতেই কাজ হয়

                        তাই কৌটো ভর্তি

                 চিনি দিই মুঠো মুঠো

                শাশুড়ির হাতে

             শ্বশুরের পাতে

          বরকে  রাতে

কৌটো শূন্য হয়

                         সম্পর্ক তবুও পানসে



নিস্তরঙ্গ



                          আয়নায় ঢেউ নেই

                   ঘুমন্ত হিংসে তাই

          সহজেই দেখে ফেলি

   মুখ তো জলেও দেখা যায়

দেখে ফেলি আয়নায়

          চোয়ালে ঝরছে রক্ত

                  দাঁতে ধরি চেপে

                       সজনে ডাঁটার মতো

                            বিবেক আর সত্য





আলোক্রেতা


ওরা সব আলোক্রেতা

ভালো ভালো তাজা আলো সব ওদের হ্যাণ্ডব্যাগে

সস্তায় পায়নি কিছুই

সস্তায় মেলেনা এক ফুটো কানাকড়িও

ওরা আলো ভর্তি ব্যাগ, বুক ভর্তি গর্ব নিয়ে

ফিরে আসে বাড়ি

ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখে হ্যাঙ্গারে

আত্মীয়-স্বজন পরিবার পরিজন

সব ছুটে আসে

                               হৈ হৈ রৈ রৈ 

চেন খুলে কেড়ে কুড়ে নখ দিয়ে আঁচড়ে নেয়

আলোর শিকড় অবধি

ওরা ক্লান্ত ঘর্মাক্ত শার্ট খুলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে



ধৈর্যহারা


কেন যে ধৈর্য হারাই বার বার

কেন যে সিংহীর মতো গর্জাই শুধু তোমারই ওপর

এর উত্তর তুমি দাওনি।

এই প্রশ্নে হেসেছিল জয়চণ্ডী পাহাড়

চূড়াখানি দুলিয়ে বলেছিল, আরে ওই লোকটা তো?

রোগা রোগা, সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের মতো টিকালো যার নাক

পাশ থেকে একটা পাখি অদ্ভুত স্বরে বলেছিল, চোখগুলো কিন্তু খুব সুন্দর ওই লোকটা তো? যে শরীরে বাতাস জড়িয়ে হাঁটে !

আমি তো পুরো থ

হঠাৎ দেখি দুটো গাছ হেসেই খুন, ডাল নেড়ে নেড়ে বললো, ওই লোকটা তো? যার বুকের ভিতর কাঁচের মতো জল

খুঁজেই নাও না বাপু একটু কষ্ট করে! 

আমি বললাম, কী ? কী খুঁজবো?

ও বললো, তোমার হারিয়ে যাওয়া ধৈর্য


বৃষ্টিতুতো


ক্ষণিক আলো, ক্ষণিকের অবসাদ নিয়ে রোজ সন্ধ্যা নামে কলেজ জীবনে কৌস্তভ বলেছিল, শ্রাবণের সন্ধ্যায় তোর ভিজে চুলের মতো স্যাঁতালো গন্ধ, মন অস্থির হয় খুব। চায়ের দোকান, ক্লাববাজি কিচ্ছু ভালো লাগে না। মনে হয় শুয়ে থাকি অর্ধেক জীবন। খোলা জানলা, অঝোর বৃষ্টি আদিগন্ত

বন্যা আসুক, মাঠ ঘাট সব ভেসে যাক। দু চোখে শুধু জল আর জল। এখন শ্রাবণ শুধু বাইশে শুরু-শেষ অভ্যেসে

তারপর থেকে বহুকাল দেখিনি বিকেল হওয়া, সূর্যাস্তের রঙ আমার তো তারিখ পেরিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা। সান্ধ্য আলো, ফেরিঘাট, পাখিদের ঘরে ফেরা এসব জন্মমৃত্যুর মতো একঘেয়ে।ভাইরাল খবর ছাড়া আজকাল ঘুরেও দেখি না ছায়া



শরীরনৌকো


তোমার শরীরের সাথে নৌকার বড় সাদৃশ্য, দুইকোণা তরমুজের সরু ফালির মতো সুচারু মাঝখানের খোলে পুরে রেখেছো তিনজন্মের তৃষ্ণা, খাঁ খাঁ চৈত্রের রোদে যেমন বিপন্ন তৃণ তেমনই তোমার ফাটল ধরা ছাতি অথচ তোমার পিঠ সারাদিন জল ছুয়ে থাকে। পিঠের তল জলজ শ্যাওলাদের প্রসবঘর, পা ফেলতে হয় সন্তর্পনে, অসাবধান হলে পরেই কলতলার মতো পিছলে পড়ি


এত কেন বৈপ্যরীত্য?


পিঠ আর বুক এরা কী চিরকাল একে অপরকে চিনবে না?
















ঘুমের ভিতর সংসার


আজ ঘুমের ভিতর তোমায় মনে পড়ছিল

কীভাবে প্রথমবার পা পিছলে তোমার ঠোঁটের মধ্যে পড়েছিলাম সে কথা

চুমু খেতে গিয়ে কিভাবে প্রথমবার গিলে নিয়েছিলাম এক ঢোক লাল সেকথা মনে পড়লে আজও ঘুমের মধ্যেই লজ্জা পাই, মুখ লুকাই ঘুমের মধ্যেই 

ঘুমের বাইরে গোটা রাত, ভাঙা চাঁদ

দূরত্ব আলোকবর্ষ আর অন্ধকার গতিহীন

তাই ঘুমের মধ্যেই সংসার







কাল্পনিক ক্লান্তি


কিছু দিন ঘোরে আছি, মানুষ মাটি সবকিছুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে মানুষের ছবি দেখি ছাদ থেকে মাথাগুলো কালো কালো, মাটির শরীর দেখি টবের ভিতর দাসত্ব করছে প্রাণপণ


এইটুকুই ; ছুঁই না ওদের


বাড়ির বাইরে বাগানে ঘোরার সময় ধুলো এড়িয়ে যেতে চপ্পল ব্যবহার করি। আমার জন্মলগ্নের মাটি, আমার পাড়াগ্রামের মানুষ সব ছেড়েছি। কাল্পনিক ক্লান্তি, এতে ঘাম নেই, গন্ধ নেই তবুও চোখ জ্বালা করে। বিচ্ছিন্ন আমি দ্বীপের মতো ঘুমিয়ে পড়ি বেলাভূমিতে, একে একে খুলে যায় সকল গিঁট

কিন্তু তোমাকে কবিতা শোনাতে আজও ক্লান্তি নেই





গোপন


ইদানিং তোমার সব ছবি দেখি খুঁটিয়ে, জুম করে। চোখের নিচের কালোটা কতখানি বেড়েছে, ঠোঁটের লাল কতখানি  ধুয়ে দিয়েছে বর্ষা, সব সব দেখি বারংবার কিন্তু তোমায় বুঝতে দেবো কেন?

কেন বলবো, দেখেছি। কেন বলবো, তোমার মুখের প্রতিটা ক্ষত আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার দেয় আজও

আমার ঈশ্বর হাসবে না? বলবে না সব অনুভূতি দেখিয়ে দিলে

ভিতরটা খালি হয়ে যায় !








সহজ ঘুম


রাত গভীর হতেই বৃষ্টিরা শুয়ে পড়লো, ওদের ঘাসের বিছানা ঘুম এলো সহজে। বৃষ্টিরা কথা রেখেছে ছুঁয়েও দেখেনি নদীর বুক, টেনে দেয়নি নদীর গায়ে ছাপা ফুলের চাদর। নদীও ক্লান্ত, দিনরাত বইতে হয় সংসারের জল তাই তার রাতই আসে দু-চোখে ঘুম নিয়ে


বৃষ্টি ঘুমালো, নদী ঘুমালো কিন্তু একটা ঘাস ফড়িং কী করবে? ঘুম এলো না কিছুতেই ! ঘাসের শাখাপ্রশাখায় উড়ে বেড়ালো, সারা রাত সে ধান রুইলো, খুব পরিশ্রম করলো তবুও ঘুম এলো না। ঘাস ফড়িংটা জানে যাদের সহজে ঘুম আসে তাদের ওপর ভাগ্য দেবতা প্রসন্ন।








বিষাদসিন্ধু


তুমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো

তুমি ঘর বাঁধবে না বলে গুছিয়ে নিয়েছো অভ্যাস

এখন আমার চারদিকে জল টলমল করে

যতদূর চোখ যায় শুধুই জলের শব্দ


জলের দোলায় ঘুম ঘুম পায়, স্বপ্নেও খেলা করে ছোটো বড় ঢেউ। আমি নির্জাত সাপের মতো হীনম্মন্যতায় ভুগি দেবাদিদেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিভ

                     চেয়ে নিই এক ভরি বিষ

          জানি বিষ ঢের ভালো বিষাদের চেয়ে





অবিন্যস্ত


আজ দুপুরে মেঝেতে মাদুর নয় অশ্রু বিছিয়ে

নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছি। তোমার অবিন্যস্ত অসহায়তার ওপর স্তুতিবাক্য নয়

শান্তিজল ছড়িয়ে দিয়েছি।


মানুষ কেন এত অসহায় হয় গো?

বিশাল এ পৃথিবী থাকতে কেন সে নিজের অন্ত্রের চারদিকেই ঘুরে মরে?


নিজেকে খোঁজার খেলায় বন বন ঘুরতে ঘুরতে

কেন যে ভির্মি খাই না! তাহলে অন্তত ভয় খেতে হয় না। তুমি দেখো এবার বিচ্ছেদের ডাক আসলে আমি আর চোখ লুকোবো না


ভাঙনে বুক পাতলেও উচ্ছ্বাস



ভারাক্রান্ত


বসুন্ধরার হাতে মস্ত লাটাই

পায়ের তলা থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে মাটি ক্রমশ

আমি সরে সরে যাচ্ছি সেই পথে

অন্ধকার যে পথে বিছিয়ে রেখেছে বিষধর দংশক

আলো ছোঁয়নি আমায়, ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ

অন্ধকারও দেয়নি আশ্রয়, ছিটিয়ে দিয়েছে থুতু

তুমিই বলো, পথ 

                                আমি কি এতই ভারি?




 






দূর-সম্পর্ক    


পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সম্পর্ক ভাঙার শব্দ শুনলেই আমি অস্থির হয়ে পড়ি। মনে হয় কত স্মৃতি ছিল পায়ে পায়ে, এখন নেলপালিশ পরা পা দুটো নিশ্চিত অন্য পা জোড়াকে মিস করছে, নিশ্চয় জুতোর রুট বদলে গেছে। এক ছাতার তলায় ছিল দুটো মাথা, ছায়াদের আলাপনে ছাতার আনন্দে দিন কাটতো। এখন ছাতাটা নিঃসঙ্গ কেবল রোদে পোড়ে, জলে ভেজে বারো মাস, ঠোঁট আড়ালের কাজ তার সমাপ্ত হয়েছে।

ভালো থাকুক সব প্রেমিক প্রেমিকারা, বিনিময়ে দূরত্ব নদী হয়ে বয়ে যাক আমার আর তার মাঝে








সহজপাঠ


যে ভালোবাসে আর যে ভালো চায়

এই দুজন মানুষকে গোটা জীবনে চিনে নিতেই হয়

নয়তো তুমি জন্মান্ধ

সব পাঠ প্রকৃতি নয় কিছু পাঠ চোখও দেয় 







খেলনা


মানুষের মন অদ্ভুত! প্রিয় খেলনা হাতে পেলে প্রথম প্রথম যত্ন করে খুব, এমন কি খেলতেও চায় না পাছে ধূলো লাগে। তারপর প্রাণভরে খেলা শুরু করে, খেলা শেষ হলেও বুকে জড়িয়ে রাখে, কাউকে ছুঁতে দেয় না। তারপর হঠাৎ একদিন নিজেই আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে, টুকরো গুলো পড়ে থাকে এদিক ওদিক।

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এমন এক দক্ষ খেলোয়াড় লুকিয়ে, যারা খেলে আর ভাঙে। ব্যতিক্রমিরা, অদক্ষরা খেলতে জানে না! আজীবন সকলের অলক্ষ্যে সযত্নে তুলে রাখে প্রিয় খেলনাখানি, অবসরে নামিয়ে ধূলো ঝাড়ে, হাত বুলিয়ে আদর করে ফের তুলে রাখে সিন্দুকে, মৃত্যুর পর ওর ভিতরেই অমর অনুভূতিগুলি জমা রেখে যাবে বলে।


সাঁঝ..












Comments

Popular posts from this blog

পাখির কাছে স্বীকারোক্তি

বিচ্ছেদের কবিতা

ভাঙন

বিষণ্ণতার গল্প

কবিতা

আধুনিক কবিতাগুচ্ছ

লক্ষ্মী ঝাঁপির ধান

গুচ্ছ কবিতা

প্রেমের কবিতা